একটি দুঃস্বপ্ন

একটি দুঃস্বপ্ন

গভীর রাতে আবরারের যখন ঘুম ভাঙল, তার মনে হলো শরীররে ভেতর দিয়ে একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল। মনে হচ্ছিল কেউ যেন তার মুখের উপর বালিশ চাপা দিয়ে রেখেছিল। সে প্রচন্ড আতঙ্কিত, ভয়ে তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। ঘুম ভাঙার পর একমিনিট মতো সে তার শরীর নাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। কোন কুস্তিগির সমস্ত শরীর জাপটে ধরে রাখলে যেরকম অনুভূতি হয় সেরকম। অবশেষে যখন পারল, সে বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে তার আব্বু-আম্মুর ঘরের দিকে পা বাড়াল। ড্রয়িংরুমে জিরো পাওয়ারের বাল্বটার আলোয় সেরকম কিছুই দেখা যাচ্ছেনা, তবুও তার মনে হলো সোফায় কেউ একজন বসে আছে। এবার আরও আতঙ্কিত হয়ে যায় আবরার, কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে শেষমেষ তার আব্বু-আম্মুর ঘরে পৌছাল। পুরনো দিনরে বাড়ি, এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে কিছুক্ষণ সময় লাগে। আবরার ঘরে ঢুকেই বাল্বটা জ্বেলে দিল। তার আব্বুর ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিরক্তির সুরে ডেকে উঠল, “কে?”

আব্বু আমি।

আবরার তুই?”, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন নাসির সাহেব।

হ্যাঁ আব্বু আমি। একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। আমাকে ওই ঘরে থাকতে ভয় করছে।

এমন সময় আবরারের আম্মুর ঘুম ভাঙল। তিনি ব্যাপারটি বুঝতে পেরে বললেন,“আচ্ছা তুই এখানে শুয়ে পড়, আমি তোর আপুর ঘরে যাচ্ছি।

আবরার বলল,“না আম্মু তুমি এখানেই থাকো, আমি তোমাদের মাঝখানে শুয়ে যাচ্ছি।

আবরারের আম্মু তার কথায় পাত্তা না দিয়ে মশারির নিচ দিয়ে বের হয়ে এলেন। তিনি আয়াতুল কুরসি পড়ে ছেলের বুকে ফুঁ দিয়ে দিলেন। আবরার তার আম্মুর জায়গায় শুয়ে পড়ল। শোয়ার আগে মাথার কাছের ঘড়িটায় দেখল রাত সাড়ে তিনটা বাজছে। আবরারের আম্মু ঘরের বাল্বটা নিভিয়ে বাইরে চলে গেল।

-----

সকালবেলা নাস্তার সময় আবরারের বড় বোন রাবয়া হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা করে ফেলল।

রাবেয়া বলল, “এত বড় ধেঁড়ে হয়েছিস আর ভূতের স্বপ্ন দেখে মা-বাবার কাছে শুতে যেতে তোর লজ্জা করল না?” বলে আবার দাঁত বের করে হাসা শুরু করে দিল। আবরারের মনে হলো তার  বোন তার বোন না, যেন আস্ত এক খেকশিয়াল।

আবরার এর প্রতিবাদে কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় আবরারের আব্বু জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা বলতো তুই স্বপ্নে আসলে কী দেখেছিলি?”

রাতের বেলা বিচিত্র রকমের স্বপ্ন আবরার দেখে থাকে কিন্তু সকাল হতে হতে সে কি স্বপ্ন দেখেছিল তা ভুলে যায়। আজকের স্বপ্নের ব্যাপার ভিন্ন। তার পুরো স্বপ্নটা স্পষ্ট মনে আছে জেনে সে নিজেই বিষ্মিত হলো! সে ছোট একটা শ্বাস নিয়ে বলা শুরু করল।

আমি স্বপ্নতে দেখলাম আমি আর আম্মু দাদির বাসা গেছি, ঠিক কি কাজে গেছি বুঝতে পারলাম না। দাদিকে দেখলাম খাটে শুয়ে পেপার পড়ছে আর বাকি সবাই যে যার মতো কাজে ব্যাস্ত।

নাসির সাহেব হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলেন, “তোর দাদিকে দেখেছিস?”

আবরার বলল,“হ্যাঁ।

হঠাৎ করে মৃত মাকে মনে পড়ে যাওয়ায় নাসির সাহেব কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েগেছিলেন। আবরার আবার তার স্বপ্নের কথা বলা শুরু করলে তিনি সেদিকে মন দিলেন।


তারপর দেখলাম ছোটকাকা ঢাকা গেছিল, ফেরত এসে তার হোন্ডার ধুলা মুছসেন। এখান পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। তারপর দেখলাম আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে সাথে বইতে শুরু করেছে ঝড়ো হাওয়া। আম্মুকে দেখলাম এরকম আবহাওয়ার মধ্যেই বাড়ি যাওয়ার জন্য বের হয়ে গেলেন। আমি আম্মুর পেছন ধরলাম। দাদির বাড়ির সদর দরজার কাছে পৌছাতে দেখলাম মেজচাচি আমার সাথে বাইরে বের হচ্ছেন হাঁটতে। এরকম আবহাওয়ার মধ্যে চাচির হাঁটতে যাওয়ার যৌক্তিকতা আমি খুজে পেলাম না। ততক্ষণে হাওয়া আরো জোরে বইতে শুরু করেছে। সদর দরজা টপকে বাইরে পা দিতেই নিজের অজান্তেই আমার চোখ চলে গেল সামনের বাড়ি মানে শফি কাকাদের বাড়ির ডাব গাছটার দিকে। সাধারণের চেয়ে আরও পাঁচগুন বড় মনে হচ্ছিল গাছটাকে। যখন গাছের চূড়াঁর দিকে ভালোভাবে খেয়াল করলাম, আমার বুক কেঁপে উঠল। দেখলাম গাছের চূড়াঁর চারদিকে সাদা আলখেল্লা পরিহিত মানুষের মতো কিছু জিনিস ঝুলে আছে। তাদের চোখ আর নাক অদৃশ্য। কিন্তু দুইঠোটের হাসি কান পর্যন্ত বিস্তৃত। কি অদ্ভুত আর রক্ত হিম করে দেওয়া সেই হাসি, ভাবতেই ভয় লাগে। আমি ভয়ে ভয়ে চাচিকে জিজ্ঞেস করলাম চাচি ওগুলো কি? তিনি আমাকে বললেন আবরার তুমি কি করলে, ওদের দিকে যে তাকাতে হয় না বলে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর অন্যদিকে দেখতে পাই মোড়ের মাথায় দাড়িয়ে আম্মু আমাকে ডাকছে। আমি এক দৌড়ে কাছে গিয়ে বললাম আম্মু ডাবগাছে মানুষের মতো ওগুলো কি? আমার ভয় করছে। আম্মু তখন একনজর ডাব গাছটার দিকে তাকিয়ে বলল ওরা হলো মানুষের প্রতিবেশি, ওদের ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আম্মুর কথা শুনে আমার ভয় ভেঙে গেল। আমি আমার হাত তুলে তাদেরকে হাই দেখানোর চেষ্টা করলাম। বিপরীতে দেখলাম ওই মানুষের মতো  জিনিসগুলোর মুখের হাসিটা আরও দীর্ঘ হয়ে গেল। সেই হাসি আমার কাছে আর ভালো লাগল না। দেখলাম ওরা মুখ উপরে করে দুই হাত আকাশের দিকে তুলে ধরল। হঠাৎ করে ঝমঝম বৃষ্টি শুরু হতে লাগল।

আম্মু এটা দেখে চেঁচিয়ে বলল, “আবরার তুই কি করলি?”

আম্মু আমার হাত ধরে হ্যাচকা টান মারল আর দৌড়ানো শুরু করল। কিন্তু আমি আর দৌড়াতে পারলাম না। এক মায়াবী শক্তির টানে ওই ডাব গাছের দিকে হাওয়ায় ভাসতে লাগলাম আর ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙে গেল।

 

এতখানি বলে আবরার এবার থামল। নাসির সাহেব তখন শুরু করলেন, “সকালে তোর ঘরে আমি গেছিলাম। দেখলাম তোর ঘরের জানালা বন্ধ করা, আর তুই গতকাল রাতে দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়েছিলি। আচ্ছা তোর যখন ঘুম ভাঙল তখন তোর মনে হয়নি শরীরের ভেতর দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে গেল?”

নাসির সাহেব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আবরারের দিকে তাকালেন।

আবরার বলল, “হ্যাঁ আব্বু।

নাসির সাহেব নিজের হাতে একটা কিল ঠুকে বললেন, “এইতো, যা ভেবেছিলাম। বদ্ধ ঘরে অক্সিজেন স্বল্পতার কারনে মানুষ অনেক সময় খারাপ স্বপ্ন দেখে থাকে। আমি এক পত্রিকায় পড়েছিলাম। তোর ভয় পাওয়ার দরকার নেই, আজ থেকে জানালা খুলে ঘুমাবি। আর ভূতের গল্প-টল্প কম পড়বি। ঠিক আছে?”

ঠিক আছে।

এমন সময় আবরারের আম্মু বললেন, “তুই ওই ভূতগুলো কয়টা দেখেছিলি?” তিনি এতক্ষণ রান্নাঘর থেকে সব শুনছিলেন।

আবরার বলল, “গাছের চারদিকে চারটা। কেন আম্মু কি হয়েছে?”

না কিছু হয়নি। আমিও এরকম একটা স্বপ্ন কয়েকদিন আগে দেখেছিলাম।তোর স্বপ্নের শেষ অংশের সাথে আমার স্বপ্ন মিলে যাচ্ছে , কিন্তু আমার স্বপ্নে আমি দেখতে পাই আমি হাওয়ায় ভেসে চলে যাচ্ছি।

এই কথা শোনার পর আবরারের মন অশান্তিতে পড়ে গেল। কারন সে একটা মিথ্যা কথা বলেছে। আবরার তার স্বপ্নে তার আম্মুকে শূন্যে ভেসে  ওই ডাব গাছের দিকে যেতে দেখেছিল। আবরার তার আম্মুকে নিয়ে খুব দুর্বল, তাই সে নিজের শূন্যে ভেসে যাবার কথা বলেছিল সবাইকে। তার ভেতরে এব্যাপারটা কাজ করছিল যে, “স্বপ্নে মাকে এরকম পরিস্থিতির শিকার হতে দেখেছি কিন্তু মুখে আমি একথা বলতে পারবনা।

শেষ কথা,

এই ঘটনার কয়েকদিন পর আবরারের আম্মু স্ট্রোক করে মারা গেল। আবরার তো সেদিন পাগলের মতো হয়েগেছিল। অনেক কষ্টে তার বোন আর আব্বু তাকে শান্ত করতে পেরেছিল। আবরারে আম্মুর কবর দেয়া হয় নাসির সাহেবদের পারিবারিক গোরস্থানে। আবরার,তার বোন আর তার আব্বু তিনদিন মতো থাকল থাকল দাদি বাড়িতে। কয়দিন সবাই তাকে অনেক সান্তনা দিল।

আজ আবরাররা চলে আসবে তাদের বাড়িতে। সে মাগরিবের নামজের পর তার আম্মুর কবর জিয়ারত শেষে দাদি বাড়ির ছাদে একা বসে আছে। আগের মতো সে এখন আর অন্ধকারে ভয় পায়না। সে সামনের বাড়ির মানে শফি কাকাদের বাড়ির ডাব গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণের জন্য তার মনে হলো ডাব গাছে ঝুলে থাকা ওই আলখেল্লা পরা শয়তানগুলো যাদের চোখ আর নাক অদৃশ্য, তারা একটা মুচকি হাসি দিয়ে আবরারকে উপহাস করছে। এটা দেখে কেন জানি তার চোখের এক কোণ দিয়ে নিজের অজান্তেই অশ্রু গড়িয়ে যেতে থাকল।

Wtitten by: মো. জাহিদ ইজাজ


Photo by photographer Raquel  Paoliello. Click here to download the picture

2 comments:

Theme images by Deejpilot. Powered by Blogger.