নিভৃত প্রেমনিকেতনে ll স্বাক্ষর দাস মুগ্ধ

 নিভৃত প্রেমনিকেতনে

স্বাক্ষর দাস মুগ্ধ



সেদিন স্কুলে আমি ওগাে তােমায় প্রথম দেখি

দোতলার করিডােরে তুমি ছিলে দাঁড়িয়ে একাকী

ক্লাসেতে শিক্ষকের পড়ায় ছিল না আমার মন

তােমাকে দেখতে দেখতে বিভাের হয়েছি জানিনা কখন

তােমাদের ক্লাসে তখনাে শিক্ষক আসেন নি হয়তাে তুমি তাই

শুধু একা পঁড়িয়েছিলে স্তব্ধ বারান্দায়

এরপর যখন শিক্ষক আমার কাছে এসে

জিজ্ঞেস করলেন পড়া আমায় মৃদু হেসে হেসে

তবুও বুঝি নি শিক্ষক আমায় প্রশ্ন করেছেন কখন

তােমার দিকেই পড়ে ছিল আমার সারা মন

শিৰক যখন তাকালেন তােমাদের করিডােরে

আমার মনটা যেন শুধু ভয় ভয় করে!

কিন্তু তুমি তখন বারান্দায় ছিলে না দাঁড়িয়ে

নইলে কী কলঙ্কই না হতাে তােমায় আমায় নিয়ে,

আমাদের ক্লাস থেকে শিক্ষক যখন গেলেন অন্য ক্লাসে

তখন তাে তােমায় দেখতে পেলাম না বারান্দার আশেপাশে

একটু পরে টিফিন হলাে, মাঠে ছুটল ছেলের দল।

তােমায় দেখার জন্য মন হলাে যে চঞ্চল

টিফিনে প্রতিদিন কিছু খাওয়ার ইচ্ছা থাকে কিন্তু সেইদিন

তােমাকে দেখার বাসনায় মন হয়েছিল বিলীন


সেদিন টিফিনে সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে

তােমাদের ক্লাসের দিকে গেলাম দ্রুতপদে ছুটে ।

কিন্তু গিয়ে দেখলাম যে তুমি নেই ক্লাসে

তােমায় দেখার ইচ্ছা ছিল যত তা নিমেষেই গেল ভেসে।

নিরাশ হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছি যখন

দেখলাম তুমি তােমার বান্ধবীর সাথে আসছ, করছ কথােপকথন

তােমার চোখে দেখলাম আমি স্তব্ধ প্রেমের ভাষা

তুমি যেন জাগালে প্রাণে নবপ্রেমের আশা,

নিচে নেমে সময় দেখতে গেলাম আমার হাতঘড়িতে


এমন সময় হাতে দেখি তােমার চুলের ফিতে

তখনাে বুঝতে পারি নি সেটা তােমার চুল থেকে

খুলে পড়ে গিয়ে আমার হাতে প্রেম দিয়েছে এঁকে

মাঠে গিয়ে আবার তাকালাম দোতলার করিডােরে

দেখলাম তােমার মুক্তবেণী তােমার পৃষ্ঠ 'পরে

দেখলাম তুমি খুঁজছ সেই ফিতেটা বান্ধবীদের সাথে

কিন্তু তােমার প্রিয় ফিতেটা যে ছিল আমার হাতে ।

অনেক খোঁজার পরেও তুমি পেলে না তােমার ফিতে আর

ত্রিশ মিনিটের টিফিনের পরে ক্লাস শুরু হলাে আবার ।


এক ঘন্টা পরে যখন একটা ক্লাস হলাে শেষ

দেখলাম তােমাদের ঘরে তােমার উদাস বেশ।

নিরাশ হয়ে তুমি জানালার দিকে তাকিয়ে

ভাবছ বােধ হয়, “আমার ফিতে কোথায় গেল হারিয়ে।”

পরদিন থেকে এসএসসি পরীক্ষা, কেন্দ্র আমাদের স্কুল

এ যেন তােমায় দেখার পথ বিপদসঙ্কুল।

নােটিশ এল, নােটিশ এল, সকলে ছুটল ক্লাসে

আমি শুধু কষ্ট পাই, অন্যেরা আনন্দে হাসে।

নােটিশ বাহক আমাদের বললেন, “ছাত্ররা সব শােনাে।

এখন হতে একটি মাস আর হবে না ক্লাস কোনাে।”

ছাত্ররা সব ছুটল আপন স্কুলব্যাগ নিয়ে কাঁধে

আমার মন ভরল তখন গভীর আর্তনাদে ।

কারণ তােমায় দেখতে পাব না দীর্ঘ এক মাস

তােমায় দেখে পাব না আর আনন্দ উচ্ছাস

সেই দুঃখভরা মন নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে

পৌছালাম গিয়ে আমাদের স্কুলের গেটে।

সবাই আছে, তবুও তুমি নেই সেইখানে

সবার মাঝে শুধু তােমার অনুপস্থিতি আমার এই মনে

কোথা থেকে জানি না হঠাৎ তুমি এসে

দাঁড়ালে নিস্তব্ধভাবে আমার পাশে ।

হঠাৎ কী ভেবে আমার কাছে চাইলে তােমার ফিতে

আমি তবুও রাজি হই নি তা তােমায় ফেরত দিতে।


এরপরে তুমি রেগে চলে গেলে শুরু হলো একমাসের ছুটি

দীর্ঘ একমাস দেখতে পেলাম না তােমার চোখ দুটি

তােমার সেই ফিতে টুকরাে করে রেখেছি পাতায় পাতায়

রেখেছি যে তা যত্ন করে আমার সকল খাতায়

সেই টুকরােগুলাের মাঝে তােমাকেই পাই খুঁজে

তােমাকে রেখেছি আমার সকল পড়াশােনার মাঝে

মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি সেই টুকরাের মাঝে হাসাে

আবার মনে হয় তুমিই শুধু বইয়ের মাঝে ভাসাে

এভাবে একমাস ভেবেছি তােমাকেই প্রতি দিনে ও প্রতি রাতে

তােমার হস্তস্পর্শ অনুভব করেছি আমার দুই হাতে


তারপর যখন শেষ হলাে আমাদের স্কুলের ছুটি

ভেবেছিলাম প্রথম দিনেই তােমায় দেব আমার প্রেমের চিঠি

তার সাথে দেব তােমার ফিতের সেই টুকরাে টুকরাে অংশ।

স্কুলে আসার পরে আমার সেই ইচ্ছা হলাে যে ধ্বংস

কোনােভাবে জানলাম তুমি সেদিন আসাে নি তাে স্কুলে

ভাবলাম যে সেদিন থেকে ক্লাস শুরু এটা তুমি গিয়েছ ভুলে।

পরের দিনও দেখলাম যে ক্লাসে এলে না তুমি

তােমায় ছাড়া ক্লান্ত এক প্রেমিক হলাম আমি

আরও দুইমাস, আরও তিনমাস কাটল তােমায় ছাড়া।

মনটা আমার তােমার প্রেমে হলাে আরাে দিশাহারা।

শুনলাম তুমি আর কোনদিনও আসবে না এই স্কুলে

আর দাঁড়াবে না করিডােরের বৃহৎ জানালা খুলে

আরাে শুনলাম তােমার বাবা বদলি হয়েছেন অন্য স্থানে

কিন্তু আমার কাছে যে তুমি কী তা কেবল অন্তরাত্মা জানে

তারপর সেই চিঠিটা দিলাম ছিড়ে ছিড়ে

কষ্ট যেন বাড়তে লাগল হৃদয় ধীরে ধীরে


প্রায় দু বছর পরে যখন ভর্তি হলাম কলেজে

দেখলাম তােমায় অতি সুন্দর নতুন সাজে।

কোনােকিছু তাে হারাতেই হয় কোনােকিছু পেতে হলে

হয়তাে তুমি সেজন্যই আমার সাথে লুকোচুরি খেলেছিলে

কলেজের দ্বিতীয় দিনে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে


তুমি যে মঞ্চ মাতিয়েছিলে অভ্যর্থনার গানে

অনেক মানুষের মাঝে তুমি পাওনি দেখতে আমায়

কিন্তু তােমায় দেখে হৃদয়ে প্রেম ফিরে আসে পুনরায়

আবার যখন তােমায় ওগাে পেলাম আমি ফিরে

প্রেমপাখি যেন ফিরল তার চিরপরিচিত নীড়ে


তােমার নাম ধরে ডাকলাম আমি অনুষ্ঠানের শেষে

বহুদিন পরে তােমায় দেখলাম এক অন্যরকম বেশে

কিন্তু তুমি সাড়া দিলে না আমার সেই ডাকে

নিচু মুখ করে চলে গেলে তুমি মুখেতে লজ্জা মেখে ।

তােমার নাম ধরে আমি ডাকলাম আবার

এলােমেলাে চুল ছড়িয়ে ছিল পৃষ্ঠে তােমার।

তুমি তারপর চলে গিয়ে বেশ কিছু দূরে

আমার দিকে তাকালে ফিরে ফিরে

আমায় দেখে লিপস্টিক রাঙা ঠোটে দিলে মৃদু হাসি

তােমার সেই হাসিতেও ছিল ছলনা, ওগাে মাের প্রেয়সী।

হয়তাে আমায় চিনতে পেরে হেঁটে এলে আমার দিকে

আমার প্রাণটা আরও ভালােভাবে প্রেম যে নিল শিখে

তােমার চোখে টানা করে কাজল ছিল, হাসি হাসি ছিল মুখ

ফিতে ফিরে চাওয়ার বায়না করে তুমি করলে যে কৌতুক

তােমায় ফিরে পেয়ে আমি আনন্দে চশমা খুলে

দেখলাম তােমায় আরাে ভালােভাবে, হাতে বােলালাম চুলে।

তােমার চুল থেকে তুমি সরালে আমার হাত

সেই স্পর্শ আমায় উজ্জীবিত করল অকস্মাৎ ।

তারপর তুমি আমার হাত ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে

নিয়ে গেলে আমায় কলেজের গেটে

কলেজ গেটে রঙিন ফিতা বিক্রি করছিল এক লােক

সেই দিকে হঠাৎ তােমার পড়ে গেল চোখ।

আমাদের ভালােবাসা ফিরে পাওয়ার এমন এক দিনে

তুমি আমার কাছে নিতে চাইলে না ফিতে কিনে

আমি তােমায় সেরা ফিতেটা কিনে দিলাম তবু ।

তুমি যেন আমাকে ফেলে আর না যাও কভু

সেই ফিতেটা বেঁধে দিলাম তােমার চিকুরে


আবার গান গাইলে তুমি অভ্যর্থনার গানের সুরে ।

হাত দিয়ে টেনে তােমার মাথা রাখলাম আমার বুকে

দেখলাম তুমি তাকালে আমার দুই চোখের দিকে

দুই হাত বাড়িয়ে আমার হালকা আলিঙ্গনে।

হয়তাে তুমি লজ্জা পেলে সেই ক্ষণে

লজ্জায় সরে গেলে মাথা সরিয়ে আমার বুক থেকে

তবুও ছাড়ি নি ওগাে সখী তােমার হাত দুটিকে।

সেই হাত ধরে আমার দিকে তােমায় আবার নিলাম টেনে

পরস্পরের প্রতি প্রেম বাড়লাে পরস্পরের মনে।

কপালে কপাল মিলন মােদের, নাসিকায় মিলল নাক

আমার দিকে চেয়ে তুমি হঠাৎ বললে, “আজ তবে থাক।”

তুমি চলে গেলে আমায় ছেড়ে দিলাম না তবু বাধা

তােমার আমার প্রেম সেদিন পূর্ণ হলাে না, রইল বাকি আধা

দূরে চলে গিয়ে দূর থেকেই আমায় দেখে হেসে

বােঝালে তুমি ফেলেছ আমায় আরও বেশি ভালােবেসে।

মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলে তুমি, ফেরালে কালােচুল

সেই চেহারায় তােমায় লাগল আরও সুমঙুল।

আমি ধন্য হলাম ফিরে পেয়ে তােমার ভালােবাসা

তুমি যেন দেখালে আমায় এক নবপ্রেমের দিশা।


দুই বছরেও তুমি প্রিয়া যাও নি আমায় ভুলে

মনে রেখাে এমনি আমাদের সেই প্রথম দেখা স্কুলে

আমায় যেমন ভুলাে নি তুমি ভুলাে না তেমন সখী

স্কুলের করিডােরে তােমার আমার প্রথম দেখাদেখি

আমায় ছেড়ে কখনাে দূরে যেও না, যত পারাে এসাে কাছে

তােমার সাথে থাকতে এ মন আজীবনই যাচে

আজকে তােমায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই ক্ষণে

আসার জন্য আবার আমার মনের নিভৃত প্রেমনিকেতনে।


 কবি পরিচিতি

কবি স্বাক্ষর দাস মুগ্ধ ২০০৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবতলায় জনুগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সুভাষ চন্দ্র দাস এবং মাতার নাম শিখা রাণী দাস। ছেলেবেলা থেকে অসাধারণ মেধাসম্পন্ন স্বাক্ষর দাস মুগ্ধ নবাবগঞ্জ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুল বৃত্তি অর্জন করেন। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার স্বনামধন্য “হরিমােহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়” এর ভর্তি পরীক্ষা ২০১৬ তে তিনি ৩য় স্থান অর্জন করেন। ২০১৮ সালে জুনিয়ার স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুল বৃত্তি অর্জন করেন। কবিতা লেখার পাশাপাশি তার গান, আবৃত্তি ও ছবি আঁকার প্রতি শখ আছে। বর্তমানে তিনি “হরিমােহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়” এ দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।

ইতিমধ্যে তার রচিত প্রায় ৩১ কবিতা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হয়েছে যা চাঁপাইনবাবগঞ্জে অনেক সাড়া ফেলেছে... 


Photo by Mayur Gala on Unsplash

No comments

Theme images by Deejpilot. Powered by Blogger.