নিষ্ঠুরতার নিবন্ধনে ll মো:ইবতেশাম-উল-হক(রাগিব)

 নিষ্ঠুরতার নিবন্ধনে


হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল অনিন্দিতার। বিছানার সামনে দেয়ালে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে পড়ল সে। একি এত বেলা অব্দি তাে কোনদিনও ঘুমায়নি। বেলা গড়িয়ে যে প্রায় সন্ধ্যা হতে চলল। সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে দুপুর একটায়। বড়জোর অন্যান্য দিন বিকেল চারটা পর্যন্ত ঘুমায় সে। কিন্তু আজ কি হলাে অনিন্দিতার? ৬ টা বাজতে চলল অথচ তার ঘুম ভাঙ্গার নাম নেই। মা তাে জানে কাল অনিন্দিতার পরীক্ষা। মা কেন তাকে ডেকে দিল না? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুম থেকে উঠে পড়ে সে। হাতমুখ ধুতে গিয়ে আবিস্কার করে বাড়িতে কেউ নেই এখন। তবে কি তাকে তালা দিয়ে ঘরে আটকে রেখে সবাই বাইরে চলে গেছে? সবাই বলতে তাে শুধু বাবা মা আর কাজের মেয়ে টুনু। "নাহ আজকে কি মরার মত ঘুমালাম আমি যে কিছুই টের পেলাম না?" ভাবতে লাগলাে অনিন্দিতা। বাথরুম থেকে বের হতে না হতেই মাগরিবের আযান দিয়ে দিল। নামাজ পড়ে এরপর পড়তে বসল সে। পড়তে বসে হঠাৎ অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ল অনিন্দিতা। বুঝতে পারল কেন তার সবকিছু আজ এত ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢােকার পথে সে যা দেখে এসেছে কোনােভাবেই তা ভুলতে পারছে না।

অনিন্দিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। একমাত্র মেয়ে বলে ছােটবেলা থেকেই বাবা মা স্বপ্ন দেখতেন মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। অনিন্দিতারও ছােটবেলায় তাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু যখন সে বড় হতে শুরু করলাে আস্তে আস্তে তার চারপাশের পরিবেশকে বুঝতে শুরু করল তখন সে অনুভব করল যে ডাক্তারি আসলে তাকে দিয়ে হবে না। তখন থেকেই সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে অনিন্দিতা। এক বুক আত্মবিশ্বাস আর আত্মসম্মানবােধ নিয়ে তার বেড়ে ওঠা। নিজের সব সিদ্ধান্ত ছােটবেলা থেকে সে নিজেই নিয়েছে। তাই জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি নিতে এসে কারাে অনুমতি কিংবা পরামর্শ নেওয়ার প্রয়ােজন অনুভব করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর মাত্র এক বছর পার হয়েছে। এই এক বছরে তার অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেক। কিন্তু আজকের মত এরকম দৃশ্য তাকে আগে কোনদিনও দেখতে হয়নি। এমন বীভৎস দৃশ্য বর্বরতার এমন নিষ্ঠুর উদাহরণ সে আগে কখনাে দেখেনি।

ঘটনার সূত্রপাত বেলা বারােটার দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে করতেই অনিন্দিতা টের পেয়েছিল ঘটনার উত্তাপ। ঘটনা এমন আহামরি কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের পক্ষে ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ। সবাই ভেবেছিল এ সংঘর্ষ এমনিতে কিছুক্ষণ পরে থেমে যাবে। তাই কেউ আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যায়নি। কারণ সেধে বিপদ ডাকার ইচ্ছে বা সাহস কোনটাই শিক্ষার্থীদের নেই। অনিন্দিতা একবার যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সিনিয়র ভাইয়া ও আপুরা তাতে বাধ সাধল। তাই সাহস থাকলেও যেতে পারিনি অনিন্দিতা। হঠাৎ করে হাতাহাতি থেকে তার রূপ নিলাে অস্ত্রের যুদ্ধে৷ দু'দলই অস্ত্র বের করে আশ্রয় নিল অস্ত্রের। গােলাগুলিতে ভারী হয়ে উঠল ক্যাম্পাসের পরিবেশ। এরপর যা ঘটলাে তার চেয়ে বীভৎস দৃশ্য বােধহয় কখনাে কেউ দেখেনি। একদল ছাত্র হঠাৎ করে হাজির হয়ে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে খুন করলাে এক ছাত্রকে। রক্তে ভেসে যেতে লাগলাে ক্যাম্পাসের পথ। এরপরে লাশগুলােকে এত অগণিত টুকরাে করল যে কার লাশ তা বুঝতে পারার সাধ্য কারাে রইল না। অনিন্দিতা ভেবে পেলােনা কি হতে পারে ছাত্রটির অপরাধ। কত বড় অপরাধ করলে একজন মানুষকে জীবন দিতে হয় এত শাস্তি পেতে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে মাথা ঘুরতে লাগলাে অনিন্দিতার। বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাে সে। বাড়ি এসে মাকে সব কাহিনী বলল কিন্তু মা সবকিছু শুনে এসব থেকে দূরে থাকতে কড়া নির্দেশ দিলেন অনিন্দিতাকে। অনিন্দিতার ভেতরের তেতাে অনুভূতি তাই এখনাে যায়নি।

পড়তে বসে এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার চোখ পড়ল ক্যালেন্ডারের দিকে। চমকে উঠল সে। আজ তার বড় ভাই আশফাকের মৃত্যুবার্ষিকী। আজ থেকে ১০ বছর আগে এই দিনে তার ভাই মারা গিয়েছিল। তখন খুব ছােট ছিল অনিন্দিতা। ক্লাস থ্রি কিংবা ফোরে পড়ে। আজ অবধি বাবা মাকে আমাকে অনেকবার ভাইয়ের মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞেস করেও জানতে পারেনি সে। সবাই বলছে "বড় হলে শুনবে'। এবার তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল কেন বাবা-মা তাকে ঘরে তালা দিয়ে বাইরে গেছে।



লেখকমো:ইবতেশাম-উল-হক(রাগিব)।শ্রেণি:নবম।হরিমোহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

No comments

Theme images by Deejpilot. Powered by Blogger.