জন্মদিনের উপহার

জন্মদিনের উপহার

 
“এই বুশরা “,বলে ডাকতেই ওর ঘোর কাটল।সে এতক্ষন তাদের ছাদের ফুলের গাছ গুলোর দিকে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে ছিল।আমি ডাকতেই অনেকটা বিরক্তির সাথেই বলল,“ঊঃ.....কী হয়েছে?”
আমি বললাম,“কিছু না, আর কতক্ষণ এভাবে দেখে যাবি?”
বুশরা একটা গাছকে দেখিয়ে বলল,“তুই জানিস গাছটা কার হাতে লাগানো?”
“কার?”
“আব্বু এটা নিজ হাতে লাগিয়েছিল।আমাকে আমার জন্মদিনে গিফ্ট হিসেবে দিয়েছিল।”
“জন্মদিনে কেউ কোনোদিন গাছ গিফ্ট দেয়? ফুল দিতে পারত.....।”
বুশরা অনেকটা রেগে গিয়ে বলল,“দিতেই পারে, তাতে তোর কী আসে যায়?”
“না....তো এত বিভোর হয়ে কী দেখছিস?”
“এই এক বছর কোন ফুলের কুড়ি আসেনি,আজ হটাৎ করে দেখতে পাওয়ায় আব্বুর কথা অনেক মনে পড়ছে।আমি কি দেখতে পেলাম জানিস?”
“কী? গাছটার চারপাশে উড়তে থাকা মৌমাছিটা তোকে খেয়ে নিচ্ছে?”
“ধুর!ফাজিল কোথাকার তোকে আর বলবইনা,জা ভাগ।”   
“আচ্ছা আচ্ছা আর বলব না,এবার বল।প্লিইইইজ।”
“আমি দেখতে পেলাম আব্বু ওই মৌমাছিটার পিঠে চড়ে আমাকে ফুলরাজ্যে নিয়ে যেতে এসেছে।জানিস আজ সকাল থেকেই আমার না আব্বুর কথা খুব মনে পড়ছে।”
ওর কথাগুলো শুনে আমারও মন খারাপ হয়ে গেল।পিতা হারানোর বেদনা সবাই অনুভব করতে পারে না,যার পিতৃবিয়োগ ঘটেছে কেবল সেই বুঝে এর বেদনা।আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা।বৃষ্টি হতে পারে।আমি বুশরাকে নিচে নামতে বললাম,ওর সাথে আমিও সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম।
বুশরার পুরো নাম আশিয়াত হক। বুশরা আর আমি খুব ভালো বন্ধু। ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় প্রাইমারিতে।সেদিনটার কথা আজও মনে আছে যেদিন আঙ্কেলের হাত ধরে দুলে দুলে স্কুল আসছিল।কিন্তু ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে ওর আব্বু যখন চলে গেলো তখন ওর কান্না শুরু হলো।সেদিন সারাদিন স্কুলে কেঁদেছিল ও।মাঝে একবার করে থামছিল আর নাকে শোঁ শোঁ করে আবার কান্না শুরু করছিল।সে তার আব্বুকে অনেক ভালোবাসে। যেদিন বুশরার আব্বু মারা যায় সেদিন ওর অবস্থা বর্ণনা করার মতো ছিল না। একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিল ও। আঙ্কেলের মৃত্যু গতবছর এক রোড অ্যাক্সিডেন্টে হয়। এরপর বুশরার স্বাভাবিক হতে অনেকদিন লেগে গেছে। তার পরও  হঠাৎ হঠাৎ করে উদাসীন হয়ে যায়।গাছের দিকে,ফুলের দিকে,আকাশের দিকে তাকিয়ে কিসব ভাবতেই থাকে। সে কিন্তু পড়ালেখাতেও বেশ ভালো। ক্লাসে ১ থেকে ১০ এর ভেতরেই রোল থাকে। কিন্তু আঙ্কেল মারা যাবার পর থেকে কেমন জানি হয়ে গেছে। আমরা তাকে অনেক চেষ্টা করেছি এটা বোঝাতে যে, যে চিরকালের জন্য হারিয়ে গিয়েছে তার অপেক্ষা করে লাভ নেই বরং এতে নিজেরই ক্ষতি করা হয়। কিন্তু সে কিছুই মানতে চায় না ওর আব্বুর কথা মনে করে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদে যায়।
নিচে এসে দরজাতে নক করতেই বুশরার আম্মু দরজা খুলে দিল। বুশরা নিজের ঘরে চলে গেল। ওকে দেখতে পেলাম ওর ঘরের বারান্দার ইজি চেয়ারটাতে গিয়ে বসল। আজকে বুশরার জন্মদিন। সে হয়তো ভুলে গেছে। কিন্তু আমরা কয়েকজন ওর বন্ধু-বান্ধব প্ল্যান করেছি একটা সারপ্রাইজ পার্টি দিব।
আকিবের ঘাড়ে দায়িত্ব পড়েছে জন্মদিনের কেকটা নিয়ে আনার। আগেই প্ল্যান করা ছিল বলে সে এসে দরজায় নক করেনি। আমাকে ফোনে একটা কল দেওয়াতেই বুঝে গেলাম আকিব এসেছে। চুপি চুপি দরজা খুলে দেখি আকিব দাড়িয়ে আছে। আকিবের সাথে হাদিদও এসেছে।সে দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে বলল,“আমিও এসেছি বন্ধু”। ওর হাতে দেখলাম কিছু ডেকোরেশনের সামগ্রী। পেছনে দেখলাম বুশরার কয়েকজন ক্লাসমেট। সবাইকে একএক করে ড্রইং রুমে চলে যেতে বললাম। সেখানে সবাই কাজ আরম্ভ করল। কাজ শুরু করার পর আমি একবার বুশরার ঘরে উকি দিতে গেলাম, যদি হঠাৎ করে চলে আসে তাহলে তো সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। দেখলাম সে আগের মতো করেই চেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ততক্ষনে বৃষ্টি শুরু হয়েগেছে। আমি মনে মনে বললাম,“কে জানে সে হয়তো ভাবছে মেঘরাজ্য থেকে তার আব্বু মেঘে চেপে তার সাথে দেখা করতে আসবে”। কথাগুলো অনেকটা অবজ্ঞার সুরেই বের হয়েছিল। কেনইবা হবে না, যে মেয়েটা আজ থেকে প্রায় এক বছর আগেও ছিল প্রাণচঞ্চল,বিভিন্ন রকমের সাহিত্য ও পুস্তক আড্ডায় বাগ্মী সে কিনা আজ নেতিয়ে পড়েছে পিতা হারানোর শোকে। এসব ভাবতে ভাবতে যখন আকাশ থেকে অবিরাম ঝরে যাওয়া বৃষ্টির দিকে কিছুক্ষণ তাকালাম আবিষ্কার করলাম সেদিক থেকে চোখ সরাতে ইচ্ছে করছে না। আচ্ছা বৃষ্টির মধ্যে কি কাউকে বশীকরণের শক্তি আছে? থাকলেও আমার তা জানা নেই। আমি হঠাৎ করেই সব কাজের ইচ্ছা হারিয়ে ফেললাম। আকিব এসে যখন একটা চিমটি কাটল তখন আমার  ঘোর কাটল। সে আমকে বলল,“তুইও কি বুশরার মতো হয়ে গেলি নাকি”? আমি একটু লজ্জা পেলাম কিন্তু বললাম না। আবার কাজে লেগে পড়লাম।
পুরো ঘর সাজাতে এক ঘণ্টা মতো সময় লাগলো। তারপর বুশরার আম্মুকে ড্রইং রুমে আসতে বললাম আর বুশরাকে ডাকতে গেলাম। বৃষ্টি কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে, কিন্তু বুশরা সেখানেই বসে ছিল। এবার দেখি তার হাতে হাবলু শিরোনামের একটা বই। প্রথমে আসতে চাইছিল না কিন্তু যখন বললাম,“তোর প্রিয় বান্ধবি সামিয়া এসেছে---” তখন চেয়ার ছেড়ে উঠল। আমি তার আসার একটু আগেই ড্রইং রুমে ঢুকে গেলাম আর দরজাটা ঠেলে দিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলাম।
বুশরা ঘরে ঢুকতেই আমি বাতিটা জ্বালিয়ে দিলাম, সামিয়া মাথার উপর সেফটিপিন দিয়ে একটা বেলুন ফাটিয়ে দিল, সবাই একসাথে বুশরাকে উইশ করলাম,‘হ্যাপি বার্থডে।’ প্রথমে তো বুশরা চমকে উঠল একটু পর উপর থেকে রঙিন কাগজ পড়তে আর আমরা সবাইকে একসাথে দেখে বেশ অবাকই হলো বলা যায়। কেক কাটাকাটি হলো,আমরা সবাই খুব মজা করলাম। সবাই বুশরাকে ওর জন্মদিনের উপহার দিলাম। তারপর বুশরার আম্মু বুশরাকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বললেন। কথাগুলো দাড়ায় কিছুটা এরকম,
পৃথিবিতে কেউই চিরদিনে জন্য আসে নি, দিন শেষে সবাইকে পরলোকগমন করতে হবে। কেউ আগে কেউবা পরে। কারও বিদায়ে কাতর হয়ে থাকলে বরং নিজেরই ক্ষতি করা হয়। এই যে তুমি দিনদিন কেমন বিষন্ন হয়ে পড়ছ, রেজাল্ট খারাপ করছ তোমার আব্বু আজ বেঁচে থাকলে তোমার এই অবস্থা দেখে খুশি হতেন? মনে রাখো তোমার আব্বু সবসময় তোমার সাথে আছে। তুমি তাকে দোয়ায় স্মরণ কর, তার স্বপ্ন তুমি ছাড়া কে পূরণ করবে?

এসব কথা শুনে অনেকদিন পর বুশরাকে প্রাণোজ্জ্বল দেখাল। আমরা বুঝতে পারলাম ওর মধ্যে কথাগুলোর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরপর আমরা সবাই মিলে ছাদে উঠলাম। ছাদে উঠে দেখতে পেলাম বুশরার আব্বুর হাতে লাগানো গাছটাতে ফুলটা ফুটেগেছে। ওটা দেখে বুশরার আনন্দ দেখে কে! সে হয়তো তার জন্মদিনের উপহারটা পেয়ে গেছে। মাথার উপর তাকিয়ে দেখি আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে তার উপর রংধনুও উঠেছে। আমি সে কথা বলতেই সবাই ‘ওয়াও,চমৎকার’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে বলতে বিষ্ময়ের সাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল।

Wtitten by: মো. জাহিদ ইজাজ

Photo by Harald Arlander on Unsplash

No comments

Theme images by Deejpilot. Powered by Blogger.